রাত পোহাবার আগে।। Before Sunrise
আমার আর তমার ডিভোর্সের
ব্যাপারটা ফাইনাল হয়ে গেলো। আমাদের
মধ্যে আর বনিবনা হচ্ছে
না। পরিবারের সবাইকে বলেই এই ডিভোর্সের
সিদ্ধান্তটা নিলাম। তবুও সবাই বললো,
শেষ চেষ্টা করতে। সেই শেষ চেষ্টার
অংশ হিসেবে পাহাড়ি বাংলোতে ঘুরতে আসা। কেবল আমি
আর তমা, এই দুজন।
বাংলোটা চট্টগ্রাম আর বান্দরবানের মাঝামাঝি
এক টিলার ওপর। আমার এক
বন্ধুর পরিচিত বড় ভাইয়ের বাবার
কেনা বাংলো, খুব রিসেন্টলি কিনেছেন।
তারা নিজেরাই এখনও একরাত থাকেননি।
আমার বন্ধুটি বলে কয়ে আমাদের
থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
এখানে আমরা তিনদিন-তিনরাত
থাকবো। এরপর বাসায় গিয়ে
যে সিদ্ধান্ত নিবো, সেটাই সবাই মেনে নিবে। আমার মনে
হচ্ছিলো, কোনো লাভ হবে
না। চেষ্টার কোনো ত্রুটি তো
করিনি। তমাই আর আগ্রহী
না আমার ব্যাপারে। কেন
আগ্রহী না, আমি জানি।
তবুও কাউকে বলিনি। আমি চাই না,
আমার জন্য তমার একটা
বদনাম রটুক সবার মাঝে।
বাংলোটার আশপাশ নির্জন। জনবসতি নেই। টিলা থেকে
বেশ দূরে উপজাতিদের একটা
গ্রাম। সেখানের বাজার থেকেই প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে হয়। এই
বাংলোর কেয়ারটেকার হিসেবে আছেন এক মাঝবয়সী
বাঙালি, নাম তনু মিয়া। তার পূর্বপুরুষরা
অনেক আগে থেকেই থাকে
এই জায়গায়, এই অঞ্চলে বাঙালিরা
আসার অনেক আগে থেকেই।
তনু মিয়া আমাদের আদর আপ্যায়নের যথেষ্ট
ব্যবস্থা করলো। কিন্তু সন্ধ্যা হতেই সে এলো
আমাদের কাছ থেকে বিদায়
নিতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
'কি ব্যাপার তনু মিয়া? তুমি
থাকবে না রাতে?'
তনু মিয়া বললো, 'না স্যার। ঐ
গ্রামেই তো আমার বাড়ি,
ওখানেই থাকবো। আপনাদের প্রয়োজনীয় সব কিছু আমি
গুছিয়ে রেখেছি, টেবিলে খাবার গরম করা আছে,
বাথরুমে দু বালতি পানি
তুলে রাখা আছে।
আমার আর থাকার প্রয়োজন
নেই। তবু যদি দরকার
পড়ে, তবে ফোন দিবেন।'
আমি আর আটকালাম না।
তনু মিয়া চলে গেলেন।
রাতে আমি আর তমা
আলাদা রুমে শুতে গেলাম।
এভাবেই শুয়েছি এই একমাস ধরে,
আজও তার ব্যতিক্রম হলো
না। এই বাংলোতে বিদ্যুৎ
নেই। মোমের আলোয় দেখলাম, খুব সুন্দরভাবে বিছানা
গোছানো। তাতেই শুয়ে পড়লাম। আমার পাশের
ঘরে তমা। ওর ঘর
থেকে আসা আলো নিভে
গেলো। আমিও আমার মোমবাতিটা
নিভিয়ে দিলাম ফুঁ দিয়ে।
শুয়ে রইলাম, কিন্তু ঘুম এলো না।
কেন যেন খারাপ লাগছিলো।
জীবনে কখনো প্রেম করিনি।
ওসব কেন যেন বিরক্তিকর
লাগতো আমার কাছে। বাবা
মা যখন আমার জন্য
তমাকে পছন্দ করলেন, সত্যি বলতে ওকে দেখে
খুব ভালো লেগেছিলো আমার।
বিয়ের আগে আমাদের তেমন
কথাবার্তা হয়নি। আমি ভেবেছিলাম তমা
আমাকে পছন্দ করবে না। জীবনে
যা চেয়েছি, পাইনি তা কখনো। আমার
বিয়ের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে
কেন? সুতরাং আমি ভেবেছিলাম, তমার
সাথে আমার বিয়েটা হবে
না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে
তমা বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলো।
পুরুষ নাকি তার শখের
নারীর অনেক বেশি যত্ন
করে। আমার বাবাকে দেখতাম
মায়ের খুব যত্ন নিতে। আমি ভেবেছিলাম
তমা আর আমার সম্পর্কটা
আমার বাবা মায়ের মতো
হবে। কিন্তু তেমন হলো না।
তমার পছন্দের মানুষ ছিলাম না আমি কখনোই।
কিন্তু এটা আমি জেনেছিলাম
অনেকদিন পর।
তমার আরেকজনের সাথে অ্যাফেয়ার ছিলো।
তার সাথে ব্রেকাপ চলছিলো।
রাগ করেই তমা আমাকে
বিয়ে করার জন্য রাজি
হয়ে যায়। কিন্তু আমাকে বিয়ে করবার পর সেই ছেলেটা
আবার ফিরতে চাইছে তমার জীবনে। তমাও
মনে মনে কেবল ওকেই
ভালোবাসে। আমার জন্য কিছু
নেই তমার মনে।
আমি তাহলে আর কিভাবে তমাকে
আটকাবো? তমা চলে যেতে
চাইছে, আমিও তাকে বাধবার
কোনো চেষ্টা করলাম না।
নিশুতি রাত। চারদিক নিস্তব্ধ।
কেবল বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ। এই পোকাটা
মনে হয় বাংলাদেশের সব
জায়গাতেই থাকে। এই
পাহাড়ি টিলার ওপর বসে ডাকতে
ডাকতে রাতের নির্জনতাকে আরো রহস্যময় করে
দিচ্ছে। আমার কেমন যেন
ঘোরের মতোন লাগে। সেই
ঘোরের মাঝে শুনতে পাই,
ঘরের জানালার ওপাশে কে যেন হাঁটছে।
আমার একবার ইচ্ছে করলো দেখার, জানালার
ওপাশে কে হাঁটছে দেখার
জন্য। জানালার ওপাশে তো জঙ্গল। কারো
তো ওখানে হাঁটার কথা নয়। কিন্তু
চোখ মেলতে পারলাম না। ভীষণ ক্লান্ত
লাগছিলো। আমি তখনি ঘুমিয়ে
পড়লাম। পুরো রাতে আর
আমার ঘুম ভাঙলো না।
সকালে তমা জিজ্ঞেস করলো,
'কাল রাতে তুমি কি
বাংলোর বাইরে বের হয়েছিলে?'
আমি বললাম, 'না তো, কেন?'
তমা বললো, 'আমার মনে হচ্ছিলো,
রাতে জানালার ওপাশে কে যেন হাঁটছিলো।'
তখনই আমার রাতের কথাটা
মনে পড়ে গেলো। আমারও
মনে হচ্ছিলো, আমার জানালার ওপাশে
কে যেন হাঁটছে। চোর-টোর নয় তো?
পাহাড়ি জায়গায় এখানে কি চোর আসতে
পারে?
ব্যাপারটা অমিমাংসিতই রইলো। আমার টিলার চারপাশ
দেখতে গেলাম। অসম্ভব মনোরম এক জায়গা এটা।
আমার যদি তমার জন্য
মনটা খারাপ না থাকতো,তবে
আরো সুন্দরভাবে সবকিছু থেকে কবিদের মতো
বর্ণনা দিতে পারতাম। কিন্তু
আমার সে অবস্থা নেই।
আমি প্রকৃতি দেখার ফাঁকে ফাঁকে তমাকে দেখতে লাগলাম। ওর সুন্দর মুখটা
আর দেখতে পাবো না কিছুদিন পর।
টিলা থেকে ফেরার পথে
সেই উপজাতিদের গ্রামে গেলাম ওদের বাজারটা দেখতে।
খুব ছোট্ট, কিন্তু সুন্দর একটা বাজার, ওদের
তৈরি করা কাপড়, তৈজসপত্র
আর শৌখিন জিনিসপাতি আছে। এখানে আরো
দুতিনজন বেড়াতে আসা লোকের সাথে
দেখা হয়ে গেলো। তারা
কাছের একটা হোটেলে উঠেছেন।
একজন আমাদের মতোই দম্পতি, কিন্তু
নিউলি ম্যারিড। আমাদের সাথে বেশ ভাব
হয়ে গেলো। আমরা যে ডিভোর্সের
আগে এখানে বেড়াতে এসেছি, সেটা ওদের জানালাম
না, শুধু বললাম ঘুরতে
এসেছি। দম্পতির মধ্যে পতিটির নাম হাসান, সে
প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করেন। আর জায়া হলো
রুম্পা, সে পুরোদস্তুর গৃহিণী।
আমাদের সাথে ঘুরতে ঘুরতেই
ওরা বললো, 'জানেন, এইখানে নাকি একটা ভূতুড়ে
বাংলো আছে। ওই বাংলোর
মালিকসহ পুরো ফ্যামিলি নাকি
বাংলোর মধ্যেই খু*ন হয়েছিলো।
কে ওদেরকে খু*ন করেছে
কেউ জানে না। ওদের
আত্মা নাকি এখনো ওখানে
ঘুরে বেড়ায়। আজকে হোটেলে বসে
সেই গল্প শুনে এলাম।'
আমি বললাম, 'দেখা দরকার তো
বাংলোটা। আমাদের বাংলোর আশেপাশে তো আর কোনো
বাংলো দেখিনি। এখানে তবে আরো দু-তিনটা বাংলো রয়েছে। আপনাদের হোটেল থেকে ঠিকানাটা নিয়ে
আসবেন তো, কাল নাহয়
সেখানে ঘুরতে যাবো।'
রুম্পা বললো, 'দরকার নেই বাবা। আমার
ভয় করে ওসব। আপনারা
যেতে চাইলে এই হাসানকে ধরে
নিয়ে যান। ও নিজেই
আস্তো একটা ভূত, ভয়ডর
কিচ্ছু নেই।'
ঠিক হলো, পরদিন আমি
আর হাসান ঐ ভূতুড়ে বাংলো
দেখতে যাবো, আর রুম্পা আর
তমা বাজারে কেনাকাটা করবে। সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে
চলে এলাম।
রাতে আগেরদিনের মতোই আলাদা রুমে
ঘুমাতে গেছি। ঘর অন্ধকার, বাংলো
অন্ধকার। চারদিকে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার
শব্দ। বাতাসে ভেজা একটা গন্ধ।
সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়েছিলো।
হঠাৎ শুনলাম, পাশের ঘরে থেকে কে
যেন চিৎকার করে উঠলো।
পাশের রুমে তো তমা
শুয়ে। কিন্তু চিৎকারটা ওর নয়। কেমন
একটা পুরুষ মানুষের গলা। আমি
ছুটে পাশের রুমে গেলাম। দেখি,
তমা বিছানায় বসে আছে। ভয়ে
ওর মুখটা এতোটুকু হয়ে গেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কি হয়েছে?'
ও বললো, 'কে যেন দাঁড়িয়ে ছিলো জানালার ওপাশে। সেই চিৎকার করলো।'আমি মোমবাতি ধরালাম। মোমবাতি নিয়ে জানালার সামনে গিয়ে চারপাশ দেখলাম। কেউ নেই।তমা ভয়ে কাঁপছে। আমি বললাম, 'ভয় পেয়ো না। চলো, বাইরে গিয়ে একবার দেখে আসি।'তমা আমার হাত চেপে ধরে বললো, 'না। আমি একদম বাইরে যাবো না। তোমাকেও বাইরে যেতে দিবো না।'ঠিক আছে। বাইরের গেটটা দেখে আসি তাহলে। ভালো মতো লাগানো আছে কিনা।'আমরা বাইরের গেটটা দেখলাম। খুব সুন্দরভাবে লাগানো আছে গেটটা। বাইরে থেকে কারো ঘরে ঢুকবার উপায় নেই।তমা হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বললো, 'আচ্ছা, রুম্পারা একটা ভূতুড়ে বাংলোর কথা বলছিলো না? সেটা কি আমাদের এই বাংলোটাই?'
আমি হেসে বললাম, 'ধুর, তা কেন হবে? শুনো, ঐগুলা সব গালগপ্প। আর চিৎকার যেটা শুনলাম, সেটাও হয়তো অনেক দূর থেকে এসেছে। রাতে চারপাশ নির্জন থাকে বলে অনেকদূরের চিৎকারও আমরা শুনতে পাই। ওটা কিচ্ছু না। চলো, এখন ঘুমাতে যাই আমরা।'তমা মনে হলো কনভিন্সড হলো না। আমি যখন ওকে ওর রুমে রেখে আমার রুমে ফিরতে যাবো, তখন সে বললো, 'প্লিজ, আমি একা থাকতে পারবো না। তুমি থাকবা আমার সাথে রাতে?'
আমি বললাম, 'ঠিক আছে।'আমরা বিছানায় দুজন দুপাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। তমা ঘুমালো কিনা জানি না, আমার ঘুম আসছিলো না। আমি ঘরে জ্বলতে থাকা মোমবাতিটা দেখছিলাম। তমাই মোমবাতিটা নিভাতে দেয়নি। অন্ধকারে ছোট ছোট পোকা এসে ভীড় করছিলো মোমবাতিটাকে ঘিরে। তাদের দুএকটার লাফ-ঝাপে একটু একটু করে কাঁপছিলো মোমবাতির শিখা। আর তাতে ঘরের আলো-আঁধারও যেন ছন্দে ছন্দে দুলছিলো।
ঘরের সেই আঁধারের মাঝে,
হঠাৎ আমি একটা চোখ
দেখতে পেলাম জানালার বাইরে। ভয়ানক শীতল এক চোখ।
চোখটা লাল।
আমি আঁতকে উঠলাম। আমাকে উঠতে দেখে তমা
ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কি হয়েছে?' আমি
ওকে কিছু বললাম না।
ততক্ষণে চোখটাও হাওয়ায় মিলিয়েছে। তমাকে কিছু হয়নি বলে
ঘুমাতে বললাম। তমা শুয়ে পড়লো।
আমিও শুলাম। কিন্তু আমার মনটা কেমন
এক আতংকে ভরে রইলো। বারবার
মনে হচ্ছিলো, কিছু একটা আছে
এই বাড়িতে। ভয়ংকর কিছু।
পরদিন তনু মিয়াকে বাড়ির
ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কিছু ঘটেছিলো কিনা।
তনু মিয়া সোজাসুজি বলে দিলো, 'না
স্যার, এখানে অমন কিচ্ছু হয়নি।'
শুনে একটু সাহস এলো।
কিন্তু কাল রাতে ঘটা
ঘটনাগুলোর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে
পেলাম না।
বিকেলে হাসানদের সাথে দেখা হবার
কথা, কিন্তু ওরা এলো না।
কি জরুরী কাজে নাকি ঢাকায়
ফিরতে হয়েছে দুজনকেই। সন্ধ্যায় আমি আর তমা
বাংলোতে ফিরে এলাম। কাল
এখানে আমার আর তমার
শেষদিন। বিকেলেই রওনা দেবো ঢাকার
জন্য। আর এখানে হয়তো
আসা হবে না। এলেও
দুজন একসাথে আসবো না কখনো।
তনু মিয়া সন্ধ্যার পর চলে গেলো।
রাত নামলো ঝুপ করে। আজকে
রাতটা ভীষণ অন্ধকার, অমাবস্যা
বোধহয়। মোমবাতি জ্বালিয়ে ডিনার সারলাম। আমি একবার তমাকে
বলতে চাইলাম, মোমবাতির আলোয় কি ভীষণ সুন্দর
লাগছে ওকে দেখতে, কিন্তু
বললাম না। ও হয়তো
ভাববে, আমি সুযোগ খুঁজছি
ওর কাছে যাবার।
খাওয়া শেষ হলো। আমরা
মুখ হাত ধুয়ে শুয়ে
পড়লাম বিছানায়।
আজ রাতটা কেমন যেন বেশি
নির্জন। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকও নেই। ওরাও
বুঝি আজকে ছুটি নিয়েছে
চাঁদের মতো। চারদিক শুনশান।
বাতাসে ভেজা গন্ধ। সন্ধ্যার
পর আজও বৃষ্টি হয়েছে,
কিন্তু রাত নামার আগেই
চলে গেছে বৃষ্টি। আমি
আর তমা একরুমেই শুলাম।
আমার ঘুম আসছিলো না।
তমার ব্যাপার জানি না।
একটা কথা ভেবে একটু
অবাক লাগছিলো। আজকে বাড়ি যাবার
সময় তনু মিয়া বলে
গেছে, 'স্যার, আজকে দরজা জানালা
কিন্তু ভালো মতো লাগিয়ে
শুবেন।'
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস
করেছিলাম, 'কেন?'
'এমনি স্যার। আজকে অমাবস্যা তো।
অমাবস্যায় বনের জানোয়াররা ঘুরাঘুরি
করে। সাপও চলাচল করে
এই সময়। আপনারা ঘরের দরজা জানালা
ভালো মতো লাগাইয়া শুবেন।
ভয়ের কিছু নাই।'
'আচ্ছা।'
'আর শুনেন, ঘরের বাইরে থেকে কেউ ডাকাডাকি করলে খবরদার দরজা খুলবেন না।'আমার মধ্যে দিয়ে ভয়ের এক শীতল স্রোত বয়ে গিয়েছিলো। জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'কেন?'তনু মিয়া উত্তর দেয়নি।হনহন করে হেঁটে চলে গিয়েছিলো। আমার তখন একটু খটকা লেগেছিলো। পরে ভেবেছিলাম, হয়তো চোর ডাকাতের জন্য বলেছিলো কথাটা। এখানে হয়তো চোর ডাকাতের উপদ্রব আছে। গত দুরাত তো এর প্রমাণও পেয়েছিলাম। যাই হোক, দরজা জানালা ভালো মতো লাগানো হয়েছে। আশা করি ভয়ের কিছু নেই।তবু মনের খটকাটা কেন যেন যাচ্ছিলো না। মনে হলো, হাসানের কাছে একটা বাংলোতে খুনের ঘটনা শুনেছিলাম না? ওটা একটু ঘেঁটে ঘুঁটে দেখি নেটে। কিছু পাওয়া যায় কিনা।
এ জায়গাতে নেট বেশ স্লো।
কোনো রকম টুজি পাওয়া
যায়। তাই দিয়ে অনেক
বাফারিংয়ের ঝামেলা পাড়ি দিয়ে ছোট্ট একটা নিউজ পেলাম
চট্টগ্রামের স্থানীয় এক নিউজ পোর্টালের।
এই এলাকারই এক বাংলোর কথা
লেখা। টিলার ওপর আছে বাংলোটা।
সেখানে বাংলোটির মালিক তার পুরো ফ্যামিলি
নিয়ে ঘুরতে এসেছিলো। একরাত ছিলো ওরা সেই
বাংলোতে। পরদিন তাদের লাশ পাওয়া যায়।
কিভাবে তারা মারা গেছেন,
কেউ বলতে পারে না।
পুলিশ তদন্ত করছে। খুব শীঘ্রই খুনিকে
শনাক্ত করা হবে।
ওখানে আরো লেখা, পুলিশ বাংলোর কেয়ারটেকার তনু মিয়া সহ আরো কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে তদন্তের কোনো সুরাহা হয়নি তাতে।তনু মিয়ার নামটা শুনে ভয়ে আমার শরীর জমে গেলো। আমাদের তনু মিয়া! এই তাহলে সেই বাংলো। তনু মিয়া মিথ্যা বলেছে তাহলে। এই বাংলোতেই তবে খু*নগুলো হয়েছিলো।আমি নিউজ পোর্টালের নিউজটা দেখি আবার। পুরো ফ্যামিলির লাশ পাওয়া গিয়েছিলো উত্তরদিকের ঘরে। সবার মুখেই নাকি ভয়ংকর আতংকের ছাপ ছিলো,যেন কোনো কিছু দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলো সকলে। অথচ কারো গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিলো না।
আমি আমাদের ঘরটার চারপাশ দেখি। কাঠের দেয়াল ঘরটায়। ঘরে জ্বলতে থাকা
মোমবাতির টিমটিমে আলো দেয়ালে পড়ে
কেমন একটা আলো-আঁধারি
ভরা রহস্যময় এক পরিবেশ তৈরি
করেছে। ঘরের বামদিকে জানালা।
বন্ধ সেটা। এটাই এই বাংলোর
উত্তরের ঘর। এখানেই কোনো
একরাতে একটা ফ্যামিলির সব
সদস্য নির্মমভাবে খুন হয়েছিলো। কেন,
কেউ জানে না। আমরা
এখন যেখানে শুয়ে আছি, সেখানেই হয়তো
পড়েছিলো তাদের লাশ। সারারাত, এই
ভয়ংকর নির্জনতায়।
প্রচন্ড ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।আর তখনি, আমাদের ঘরে জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে কে যেন চিৎকার করে উঠলো ভয়ংকরভাবে।আমার বুকটা ধক করে ওঠে। তমা উঠে বসে। আমাকে জিজ্ঞেস করে, 'কিসের ডাক ওটা?'আমি বলতে পারি না।আমার শুকনো মুখ দেখে তমা আরো ভয় পেয়ে যায়। বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকে, কি হয়েছে।আমি ওকে কিচ্ছু বলি না। বললে ও ভয় পেয়ে যাবে আরো।চিৎকারটা এবার হিংস্র গর্জনে পরিণত হয়েছে। কে যেন গজরাচ্ছে জানালার ওপাশ থেকে। জানালার কপাটে আঁচড় কাটছে কেউ। ভয়ে তমা আমাকে আঁকড়ে ধরে। ওর শরীর কাঁপছে থরথর করে। আমারও একই অবস্থা। আমরা আতংক নিয়ে তাকিয়ে থাকি জানালার দিকে।আঁচড়ের শব্দটা হঠাৎ থেমে যায়।
জানালার ওপাশে পায়ে হাঁটার শব্দ। কে যেন আমাদের
পুরো বাংলোর চারদিকে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে আবার আমাদের জানালার
সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি
আশা করছিলাম আবার সেই চিৎকার
শুনবো। কিন্তু না। তেমন কিছুই
শুনলাম না। তার বদলে,
তনু মিয়ার চিরপরিচিত কন্ঠটা শুনলাম, 'আপনারা ঠিক আছেন স্যার?'
ওর কণ্ঠটা শুনে যেন আমাদের বুকে প্রাণ ফিরে এলো। আমি বললাম, 'তনু মিয়া, তুমি এসে তো খুব উপকার করলে আমাদের। বাইরে কি যেন শব্দ করছিলো।''জি স্যার। বন বিড়ালের মতো কি একটা দেখলাম। আমাকে দেখেই পালিয়ে গেলো।''বনবিড়াল ওভাবে গর্জন করে?''করে স্যার। বেশ বড়গুলো করে। এখন আর ভয় নেই। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। আর আমি থাকবো আপনাদের সাথে।'
'খুব ভালো হবে তাহলে।'স্যার। তাড়াতাড়ি একটু দরজাটা খুলে দেন। আমি ভেতরে আসি।'আমি আর তমা দুজনেই গেলাম দরজা খুলতে। তমার সাহসটুকু ফিরে আসাতে ওকে উচ্ছল কিশোরীর মতো লাগছিলো। আমার আগেই ও দৌড়ে চললো দরজা খুলে দিতে।দরজার ছিটকিনিতে তমা হাত লাগিয়েছে, তখনই আমার যেন কেমন লাগলো। তমাকে বললাম, 'একটু দাঁড়াও তো।'
তমা অবাক হয়ে বললো, 'কেন?' আমি বললাম, 'তনু মিয়াকে ফোন করি একটা।'
তমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। দরজার বাইরে তখন তনু মিয়ার আওয়াজ। বললো, 'ম্যাডাম, দরজাটা একটু খুলে দেন তাড়াতাড়ি।' আমি তনু মিয়াকে ফোন দিলাম। নেটওয়ার্কের সমস্যা। কল ঢুকলো না। আমি আবার কল দিলাম। আবার সমস্যা। এভাবে তিনচারবার হলো। তমা বিরক্ত হয়ে বললো, 'পাগলামি করছো কেন? আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।' বলেই ছিটকিনিতে হাত লাগালো। আর তখনই তনু মিয়া ধরলো ফোনটা, 'জি, স্যার?''তনু মিয়া, তুমি কোথায়?''কোথায় থাকবো আর স্যার, বাসাতে। কেন স্যার?' আমার ফোনটা লাউডস্পিকারে ছিলো। শেষ কথাটুকু শুনেই তমার হাত জমে গেলো। ভীষণ আতংকের এক ছাপ ফুটে উঠলো তার মুখে।
ফোনটা ততক্ষণে কেটে গেছে। নেটওয়ার্কের সমস্যা। আর তনু মিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না।দরজার ওপাশে তনু মিয়ার কণ্ঠটা ততক্ষণে বদলে গেছে। ভীষণ জান্তব, ফ্যাসফ্যাসে এক কণ্ঠ। কণ্ঠটা বললো, 'এভাবে দরজা আটকে থেকে পার পাবি না। আমি ঘরের ভেতরে ঢুকবোই।'আমি বললাম, 'আপনি কে? কি চান আমাদের কাছে?'কণ্ঠটা হঠাৎ হাসতে লাগলো। কি ভীষণ ভয়ংকর সে হাসি। হাসতে হাসতেই সে বললো, 'শুধু তোদের প্রাণটা চাই আমাদের। মহান শয়তানের জন্য।'তমা পিছনে চলে এসেছে। ভয়ে কেঁদে ফেলেছে সে। চিৎকার করে বললো, 'প্লিজ বলো। কি হচ্ছে এসব।'আমি বললাম, 'জানি না। শুধু মনে রেখো, আজ রাতে এদেরকে আমরা ঘরে ঢুকতে দিবো না। কিছুতেই না।'
আমি তমাকে নিয়ে পুরো ঘর ঘুরে
দেখতে দেখলাম। কোথাও কোনো ফাঁকফোকর আছে
কিনা ঢুকে পড়ার মতো।
নেই। এদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত
হলাম। এরপর ওকে বললাম,
ডাইনিং টেবিলটা আমার সাথে ধরে
দরজার সামনে নিয়ে আসতে। ব্যারিকেড দেয়া লাগবে। ও চুপচাপ আমার
সাথে ডাইনিং টেবিলটা ধরলো। ভারি মেহগনি গাছের
টেবিল, অনেক কষ্টে টেবিলটা
দুজন মিলে ধরে দরজার
ওপর চাপিয়ে দিলাম। ওপাশ থেকে তখন
দরজায় ভীষণ জোরে ধাক্কানো
শুরু হয়ে গেছে। কেউ
যেন ভেঙে ফেলবে দরজা।
রাত তখন প্রায় তিনটা। আরো দু ঘন্টা আছে ভোর হবার।দরজায় ধাক্কানোর আওয়াজ ততক্ষণে বেড়ে গেছে। ওপাশে জান্তব পশুর আওয়াজ। আর ভীষণ ভয়ের সাথে বুঝতে পারলাম, আমাদের জানালাগুলোতেও যেন কারা জোরে জোরে ধাক্কা দেয়া শুরু করলো। সারা বাড়িতে তখন কাঠের ওপর বাড়ির আওয়াজ।তবে সেগুলোর থেকেও ভয়ের লাগছিলো বাইরের আওয়াজগুলো। ভীষণ আক্রোশে গর্জন, আর ভয়ানক পৈশাচিক হাসিতে ভরে গিয়েছিলো বাংলোর চারপাশ। আমার দুজন জড়াজড়ি করে বসে রইলাম বাংলোর ভেতর।
শব্দগুলো বেড়েই চললো। আর সেইসময়, আমাদের আতংক বাড়িয়ে দিয়ে, দরজায় মড়াৎ করে শব্দ হলো।ভেঙে যাচ্ছে দরজাটা।আশেপাশের জানালায় তখন শব্দ থেমে গেছে। সবাই এসে একসাথে হামলে পড়েছে আমাদের দরজার ওপর। দরজাটা বেশিক্ষণ টিকবেনা। টেবিলটাও নড়তে শুরু করেছে, পড়ে যাবে যেকোন সময়। আমি দৌড়ে গিয়ে টেবিলটা ধরলাম। তমা আমার পাশে এসে টেবিলের আরেকপাশ ধরলো।ধাক্কার পরিমান বেড়ে গেলো। বুঝলাম, এই আমাদের শেষ। আর বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারবো না ওদের।তমাকে দেখছিলাম। আতংকে এতোটুকু হয়ে গেছে ওর মুখ। তবুও কি ভীষণ সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে। ওকে আমি বলেই ফেললাম, 'আমাদের হাতে আর বেশি সময় নেই। তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো। তোমার মতো সুন্দর কাউকে আমি কখনো দেখিনি। আজকের পর যদি আর একটাদিনও বাঁচতে পারি আমি, তো সেই দিনটাও কেবল তোমার সাথে বাঁচতে চাই।'
তমা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। টেবিলটা আর আটকানো গেলো না। ধাক্কার চোটে আমরা সরে গেছিলাম, আমাদের সাথেই উল্টে পড়লো টেবিলটা। দরজার পাল্লাও ছুটতে শুরু করেছে। ওপাশে আর্তনাদের বদলে এখন কেবল পৈশাচিক হাসির উল্লাস।তমা হঠাৎ বললো, 'তোমাকেও একটা কথা বলার ছিলো। আমার কোনো অ্যাফেয়ার ছিলো না।''কিহ?''হ্যাঁ। তোমাকে ভালো লাগছিলো না, তাই ডিভোর্স নিতে উল্টোপাল্টা গল্প শুনিয়েছিলাম।'আমি অবাক হয়ে তমার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দরজার পাল্লা ততক্ষণে ভেঙে গেছে। দরজাটা খুলে যাচ্ছে। ওপাশে মানুষের মতো বড় কিছু একটা দেখতে পারছি আমরা।আর তখনই, হঠাৎ সব থেমে গেলো।
ঐ জিনিসগুলো যেন পালিয়ে গেলো কই। প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি কি হলো। একটু পরেই বুঝলাম। তনু মিয়ার সাথে শত শত গ্রামবাসী চলে এসেছে আমাদের বাঁচাতে। সবার হাতেই মশাল। মশালের আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে গেলো।তনু মিয়া দরজার ওপাশ থেকে আমাদের দেখে মুচকি হেসে বললো, 'যাক, তাহলে বাঁচাতে পারলাম আপনাদের।'এরপরের ঘটনা সামান্য। পুলিশ এলো। আমাদের জবানবন্দি নিলো। গ্রামবাসীরা জানালো, এই টিলা আর পাহাড়গুলোতে খারাপ কিছু থাকে, তারা অনেক আগে থেকেই জানে। এজন্যই এসব জায়গায় বাড়ি করতে দিতে চায়না তারা। কিন্তু কেউ শোনেনা। পুলিশের তো এমন অতিপ্রাকৃত কথা শুনে লাভ নেই। তারা চলে গেলেন। তনু মিয়া জানালো, আমার ফোন কেটে যেতেই সে বুঝে গিয়েছিলো খারাপ কিছু হচ্ছে এখানে। তাই সবাইকে নিয়ে ছুটে এসেছিলো। আগের মালিককে যেভাবে হারিয়েছে ,আমাদের আর কিছুতেই সেভাবে হারাতে দিতে চায়নি সে।
বিকেলবেলা। সবকিছু থেমে গেছে। আমি আর তমা টিলায় বসে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখছি। একটু পরেই আমাদের বাস। আর হয়তো আসা হবে না এখানে। এলেও, দু'জনের একসাথে আসা হবে না।আমি তমাকে বললাম, 'চলো, মালামাল গুছিয়ে নেই। দেরি হয়ে যাচ্ছে।'তমা বললো, 'থাকুক। পরে গুছাবো। আরো কিছুক্ষণ থাকবো এখানে।''দেরি হয়ে যাবে।'যাক।''কাল ডিভোর্স পেপারে সাইন করার ডেট, মনে আছে?'থাক। ওটার কথা পরে ভাববো।'তমা আমার কাঁধে মাথা রাখে। সূর্য তখন লাজরাঙা হয়ে পশ্চিমাকাশে ডুব দিচ্ছে ধীরে ধীরে।
Post a Comment