ভ্রান্তি।। The Ghost Girl
"ভ্রান্তি"
"এই বাড়িতে জ্বীন আছে!"
মাত্র তিনদিন আগে ওঠা ভাড়াটিয়ার মুখে এই কথা শুনে ভয়াবহ বিরক্ত হলেন রমজান সাহেব। কটমট করে তাকালেন সামনে সোফায় জবুথবু হয়ে বসে থাকা সবুজ মিয়ার দিকে।
"তুমি জানো এই বাড়িতে আমি কয় বছর ধরে বাস করতেছি?" থমথমে গলায় প্রশ্ন করলেন রমজান।
"জ্বী না।"
"১৬ বছর। ১৬ বছর
ধরে এই বাড়িতে থাকি
আমি। নিজের হাতে নিজের টাকায়
করা বাড়ি। কত শত ভাড়াটিয়া
আসলো গেলো, কোনদিন কারো মুখে কিছু
শুনলাম না। কেউ কোন
অভিযোগ দিলো না, আর
তুমি তিনদিন হয় এই বাড়িতে
উইঠাই বলে দিলা আমার
এই বাড়িতে জ্বীন আছে? ম...মশকরা
কর?"
রমজান সাহেবের কথা আটকে যাচ্ছে
মুখের ভিতর। বেশি রাগ উঠলে
এমন হয় তার। সবুজ
মিয়া আস্তে আস্তে বললো,
"আমি আপনার সাথে মশকরা করবো
কেন? আপনি আমার বাবার
বয়সী। আপনার সাথে মশকরা করা
সাজে না। যা সত্য
তাই বলেছি।"
"সত্য? কি সত্য? কেমনে
বুঝলা জ্বীন আছে? দেখাও আমারে।
আজকে রাতের মাঝে যদি দেখাতে
না পারো কাল সকালের
মধ্যে আমার বাড়ি থেকে
বিদায় হবা। বুঝছো যা
বলছি?"
"জ্বী"
মাথা নাড়লো সবুজ। "রাত এগারোটার পর
আপনি আমার রুমে আসবেন।
আপনাকে দেখাবো। এখন আমি যাই?"
আগুনঝড়া চোখে সবুজের দিকে
তাকিয়ে রমজান বললেন, "যাও। আমি এগারোটার
পরেই আসবো। আর যদি দেখাইতে
না পারো, যা বলছি মনে
থাকে যেন!"
মাথা নিচু করে দরজা
খুলে বেরিয়ে গেলো সবুজ। তিনতলা
এই দালানের নিচের তলায় থাকে সবুজ।
তিনতলায় থাকেন রমজান সাহেব। একতলা আর দোতালা অনেকদিন
ধরেই খালি, প্রায় দুই বছর হবে।
সবুজ একাই উঠেছে নিচতলায়।
ভাড়া কম। পুড়নো দিনের
বাসা। চাহিদাও নেই তেমন। সবুজের
একার খরচেই চলে যায় থাকা
খাওয়া মিলিয়ে।
রমজান সাহেবের মাথায় এখনো আগুন ধরে
আছে। দুই বছর ধরে
ভাড়া দেন নাই এই
বাড়ি কাউকে। কয়েকজন এসেছিলো, কিন্তু ওদের দেখেই মেজাজ
এত খারাপ হয়েছিলো, দূর দূর করে
তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তার উপর পুরনো দিনের
বাড়ি আর আশেপাশে বড়
বড় টাইলস মোজাইক করা ১০ তলা
২০ তলা ফ্লাট বাসা
উঠে যাওয়ায় কেউ আর আগ্রহ
ও দেখায় না তার বাড়ির
দিকে। ছেলেটাকে ভালো লেগেছিলো তাই
ছেলেটা বারকয়েক অনুরোধ করাতে আর না করতে
পারেননি।
কিন্তু এত বড় ফাজিল
জানলে চিন্তাও করতেন না! জ্বীন আছে...!
তার বাড়িতে জ্বীন? ফাজলামো! রাতে যদি কোন
রকম ভুজংভাজাং করে তারে জ্বীনের
মিথ্যা ভয় দেখানোর চেষ্টা
করে চাবকে আগে ছেলেটার পিঠের
ছাল তুলবেন পড়ে রাতেই ঘাড়
ধরে বের করবেন বাড়ি
থেকে।
দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন রমজান।
বিকেল পাঁচটা। ভেবেছিলেন বাইরে যাবেন। বেশ কিছুদিন হয়
নিজের স্ত্রী আর একমাত্র ছেলের
কবর জিয়ারত করতে যাওয়া হচ্ছে
না। আজ যাওয়ার ইচ্ছে
ছিলো। কিন্তু মুডটাই নষ্ট করে দিয়ে
গেছে।
বছর দুই আগে এক
মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় নিজের স্ত্রী মেঘনা আর ছেলে আজমানকে
হারান রমজান সাহেব। ভাগ্যক্রমে কিংবা দূর্ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে
যান। তখন থেকেই একটু
এলোমেলো হয়ে গেছে তার
জীবন। এখনো নিজের বউ
বাচ্চার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে একাকি জীবন
কাটাচ্ছেন।
কোথাও বের হলেন না
রমজান। ইজি চেয়ারে কাৎ
হয়ে থম মেরে বসে
রইলেন। ১১ টা বাজার
অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিছু
খেলেন ও না। ভয়ংকর
রাগ লাগলে কিছুই খাওয়ার রুচি হয় না
তার।
ঠিক এগারোটা বাজতেই একতলায় হাজির হলেন রমজান। দরজা
খোলাই ছিলো। সবুজ তাকে ভিতরে
নিয়ে গেলো। দুটো বেডরুম, একটা
ডাইনিং, কিচেন আর একটা বাথরুম।
এই সবুজের বাসা।
সবুজ তাকে ভেতরের বেডরুমে
নিয়ে গেলো। ফ্লোরে বেডিং করা। একটা ছোট
টেবিল। এলোমেলো কিছু জামাকাপড়, আর
একটা আয়না। বিরাট বড় একটা আয়না।
যে কারো।চোখ প্রথমেই আয়নার দিকে পড়বে... এত
বড়।
"কই তোমার জ্বীন? এই আয়নার ভিতরে?"
টিটকারির গলায় প্রশ্ন করলেন
রমজান।
সবুজ তার দিকে অদ্ভুত
দৃষ্টিতে তাকালো। তার মুখে হালকা
বিদ্রুপের হাসি।
"যদি বলি হ্যা? এই
আয়নাতেই দেখতে পারবেন?"
"কি? জ্বীন?" ঘর কাঁপিয়ে হেসে
উঠলেন রমজান। সবুজ গম্ভীর মুখ
দেখে হাসি থামালেন।
"আচ্ছা, দেখি কোথায় তোমার
জ্বীন!" বলে আয়নাটার সমানে
দাঁড়ালেন তিনি।
আয়নার দিকে তাকাতেই ঘরের
লাইট অফ করে দিলো
সবুজ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রথম একটু চমকে উঠলেন
রমজান। "আলো নেভালে কেন?"
"আপনার কি মনে হয়
আলোতে দেখতে পাবেন জ্বীন? আর... আপনি কি ভয়
পাচ্ছেন?"
সবুজের গলা শুনে নিজের
উপর বিরক্ত হলেন রমজান।
"ভয়? আমি? হাহ! তোমার
এসব সস্তা ট্রিক্স দিয়ে আর কাউকে
ভয় দেখাতে পারো ছোকড়া, আমাকে
না!"
বলতে বলতে হাতের মোবাইলের
ফ্লাশ লাইট অন করে
আয়নায় ধরলেন। প্রথমে আলোর প্রতিফলনের জন্য
কিছুই দেখলেন না। চোখ কুঁচকে
ভালো করে তাকাতেই থমকে
গেলেন।
ভয়ংকর চমকে গিয়ে হাত
থেকে মোবাইলটা পড়ে গেলো। কাপা
কাপা হাতে ওটা তুললেন
আবার। কিন্তু আর জ্বালানোর দরকার
পড়লো না। স্পষ্টই দেখতে
পাচ্ছেন আলো ছাড়া।
আয়নার ওপাশে... একটা মহিলা আর
একটা ছোট্ট বাচ্চা। ওই চেহারাদুটো তার
খুব চেনা।
তার স্ত্রী মেঘনা! আর একমাত্র আদরের
ছেলে... আজমান! ওরা আয়নার ওপাশে...
কিভাবে সম্ভব! দুই বছর আগেই
তো তার চোখের সামনে
ওরা দু' জন...!
এ হতেই পারে না।
নিশ্চয়ই তাকে বিভ্রান্ত করছে
সবুজ নামের ছেলেটা। সে কি কোন
সাইকিক? হ্যালুসিনেশনস করাচ্ছে তাকে দিয়ে? কোন
গ্যাস যা তার ব্রেইনে
ইফেক্ট করছে? না অন্য কিছু!
আয়নার ওপাশ থেকে তার
দিকে একটা হাত বাড়িয়ে
দিলো তার স্ত্রী...! রমজানের
খুব ইচ্ছে করছে হাতটা ধরতে।
সাহস পাচ্ছেন না। এত জীবন্ত
মনে হচ্ছে কেন? আজমান তার
দিকে বড়বড় চো করে
তাকিয়ে আছে। খুব করে
কোলে নিতে ইচ্ছে করছে
তার আজমানকে।
"কি? বিশ্বাস হলো?" ফিসফিস করে ভেসে আসলো
সবুজের গলা।
"কিভাবে!!"
বিরবির করছেন রমজান। "এত জীবন্ত, এত
বাস্তব! নিশ্চয়ই কোন কারসাজি! আ...আমি বিশ্বাস করি
না... কিন্তু, কিন্তু করতে চাই! খুব
করে চাই...!" রমজান সাহেবের চোখে পানি। তার
গলা জড়িয়ে আসছে।
"আপনি কি ওদের ফিরে
পেতে চান?" সবুজের প্রশ্ন।
"এও কি সম্ভব?" ঘোরলাগা
কন্ঠে উত্তর দিলেন রমজান।
"আয়নায় বাড়ানো হাতটা ধরুন। আপনি ফিরে পাবেন
হারানো সবকিছু। হাতটা ধরুন...!"
মন্ত্রমুগ্ধের
মত নিজের হাতটা বাড়িয়ে ধরলেন আয়না থেকে বেড়িয়ে
আসা হাতটা। সাথেসাথে তার মনে হলো
প্রচন্ড শক্তিতে কেউ তাকে হেঁচকা
টানে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে...
আয়নার জগতের অসীম শূন্যতায়। রমজান
চিৎকার করতে চেয়েও করলেন
না... কোলে ওঠার জন্য
তার দিকে দুই হাত
বাড়িয়ে রেখেছে আজমান... তার আদরের ছেলে।
কতদিন ছেলের স্পর্শ পান না... কতদিন
ছেলের গন্ধ পান না।
আয়নার ভেতরে মিশে যেতে যেতে
দু চোখ বন্ধ করে
ফেললেন রমজান... মিশে গেলেন অসীম
শূন্যতায়...!
পরিশিষ্ট...
তিনতলার বাসায় সোফায় বসে আছে সবুজ।
হাতে চায়ের কাপ। সামনের সোফায়
বসে আছে...
মেঘনা রহমান আর তার ছেলে
আজমান রহমান... দুই বছর আগে
এক মোটরবাইক দূর্ঘটনায় মারা যাওয়া রমজান
সাহেবের স্ত্রী আর ছেলে সন্তান।
সেদিন দূর্ঘটনার পর রমজানের শরীর
রাস্তা থেকে ছিটকে গিয়ে
পড়েছিলো পাশের ডোবায়। মেঘনা আর আজমানকে অচেতন
অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়
হাসপাতাল। সেখান থেকে মেঘনার বাবা
তাদের নিয়ে চলে যান
বিদেশ, উন্নত চিকিৎসার জন্য। রমজানের লাশটাও কেউ খুঁজে পায়নি।
সেই থেকে রমজান এই
বাড়িতেই থাকে।
মেঘনা সবুজের দিকে তাকিয়ে মৃদু
গলায় একবার বললো, "অনেক ধন্যবাদ আপনাকে...!"
সবুজ উত্তর না দিয়ে মাথা
নেড়ে সেটা বিনয়ের সাথে
গ্রহণ করলো। দুই বছর আগে
মারা যাওয়া রমজানের আত্মা এতদিন শোক পালন করে
গেছে একাকী...! কাউকে থাকতে দেয়নি এই দুই বছর।
তার ভয়ে কেউ এই
বাড়ির ধারে কাছেও আসেনি
দু বছরে।
সবুজের কিছু সহজাত ক্ষমতা
আছে। জন্ম থেকেই পাওয়া।
মৃত মানুষ দেখতে পাওয়া, তাদের সাথে কথা বলা
এমনকি তাদের গোলকধাঁধায় ফেলে দেয়া... তার
কাছে খুব সহজ কাজ।
তাই মেঘনার অনুরোধে রমজানকে সেই আয়নার ভেতর
আঁটকে দিয়েছে সবুজ..!
অন্তত সেখানে সে ভালো থাকুক...
হয়তো!
Post a Comment